Categories
Legal Politics VAW

বাংলাদেশে কি নারী-বান্ধব সমাজ সুদূরপরাহত?

ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে, সম্পত্তিতে অধিকার দিতে ও বৈষম্য হ্রাস করতে অনেক কিছু করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন
“কর্মজীবী নারীদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, অফিস থেকে ঘরে ফেরার পর স্ত্রীদেরই সব কাজ করতে হয়। তাঁদেরকে গৃহকর্মে সহযোগিতা করার জন্য পুরুষদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানান। অফিস-আদালতে ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রী নারী পাচার বন্ধ ও সব ধরনের নারী নির্যাতন বন্ধ করে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।”
কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ  না নেওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো মধ্যযুগীয় অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে যতক্ষণ না কোন ঘটনাকে সাংবাদিকরা সামনে নিয়ে আসে বা ভিকটিম বা তার আত্মীয় বা এলাকাবাসী পথে নামে, ততক্ষণ প্রশাসনও ভাবলেশহীন থাকে। এরপর মামলা নেয়া ও তদন্তকাজে পুলিশের গরিমসি, ভুল অভিযোগপত্র দিয়ে আসামীকে রক্ষার চেষ্টা, বিচারকাজ বিলম্বে হয়রানি তো আছেই। একেকটা মামলা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে।
ASK_Domestic Violence_2016
গত বছর সারাদেশে কমপক্ষে ১৯১ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সঠিক সংখ্যাটি হয়তো কয়েকগুণ বেশি হবে। নিয়মিত নির্যাতনের ঘটনার বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়না, কেননা সেসব নারীরা আইনী সহায়তা নেন না

ফলে দেখা যায় বেশিরভাগ মামলায় আসামীরা সহজেই জামিনে বের হয়ে যায়, বিচার শেষে খালাস পায় বা সামান্য সাজা হয়। এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে ভেবে অনেক নারীই আইনী সুবিধা নিতে ইতস্তত করে। তবে আজকাল পত্রিকা-টিভি ও সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে; যে কারনে উচ্চশিক্ষিত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু ঢাকা ও মফঃস্বলের নিম্ন আয়ের মানুষেরা নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করাকে অপরাধ হিসেবেই দেখে না।

এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেনঃ “একটা মজার কথা বলি, পার্লামেন্টে আমি প্রশ্নোত্তর পর্বে উত্তর দিয়ে থাকি। সেখানে একজন সংসদ সদস্য [হাজি সেলিম] আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ভবিষ্যতে পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন করা হবে কিনা।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি আর কি বলবো ওনাকে বললাম আপনার যে এত কষ্ট তা তো জানতাম না। আপনি বলেন, আমরা দেখবো, কিভাবে আপনার সমস্যা সমাধান করা যায়।”
“যাই হোক ভবিষ্যতে হয়তো সেদিন আসতে পারে। দেখা যাবে আমাদের হয়তো ওরকম আইনও (পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন) করতে হচ্ছে।”
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মহিলা ‍ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, সচিব নাছিমা বেগম, ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্রিস্টিন হান্টার।
শেখ হাসিনা বলেন, মেয়েরাতো খুব বেশি নির্যাতন করে না, নির্যাতিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বোনদের বলবো, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। এই কথাটা মনে রাখতে হবে। একটা সংসারকে সুন্দর করে রাখতে মেয়েদের অনেক দায়িত্ব থাকে, সে দায়িত্ব তারা নিশ্চয়ই পালন করবে। কথায় তো আছে, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।”
২০১৫ সালে জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন করার দাবি জানান।
হাজি সেলিম বলেছিলেন, বর্তমানে দেশে শুধু নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন থাকলেও সমাজে বহু পুরুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীও হয় ভয়ংকর। আমি চাই-পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে একটা আইন হোক।
ASK_dowry_2016
যৌতুকের প্রকোপ গত তিন দশকে অনেকাংশে কমলেও এখনো শত শত নারী যৌতুক দিতে না পেরে নির্যাতনে মারা যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেছিলেন, আমি বহু আগে থেকে বিচার-সালিশ করি। স্বামী-স্ত্রীর বিচার করতে করতে আমি দেখেছি- ২০টা বিচার এলে এর মধ্যে ১৫টি নারীর। …স্বামীকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে তারা থানায় যায়; তা করতে গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর, ননদ, ভাসুর সবাইকে নারী নির্যাতন মামলা দেয়। আর পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে হানা দেয়; সবাই বাড়ি ছাড়ে। ওই বাড়ি তছনছ হয়ে যায়।

একই সুরে ২০শে আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করলো কিছু ব্যক্তি।

একটা আচানক অসভ্য দেশ এইটা। এইগুলা পত্রিকাওয়ালারা ফলাও করে ছাপে!
এই বক্তব্যের একমাস পর ৪ঠা এপ্রিল কলেজ ছাত্রী তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রচলিত আইনেই এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার করা সম্ভব এবং আমরা সেটাই করবো।”
উনি এটা বলার কারন হলো প্রধান বিচারপতি তার কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইন দিয়ে তনু হত্যার বিচার করা যাবে না। পুরনো মানসিকতায় তদন্ত করে এর সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ আইন অচল হয়ে গেছে। এসব আইনের ব্যবহারিক কার্যকারিতা অনেক কম। এ সময় তনু হত্যার ঘটনাকে একটি আধুনিক অপরাধ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী তখন বলেন, “আমাদের দেশের প্রচলিত আইনেই তনু হত্যার বিচার করার সুযোগ রয়েছে। প্যানেল কোর্টে না হলেও নারী নির্যাতনের আলাদা আইন রয়েছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। আমরা এসব আইনে এ হত্যার বিচার করতে পারবো।”
এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আইনের দিক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। তাদের আগেই আমরা দ্রুত বিচার আইন প্রণয়ন করেছি। এখানেই আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছি।
গত একটা বছর মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স কমানো নিয়ে কি কান্ডটাই না হলো। সরকারের মনোভাব দেখে মনে হলো কোন কিছু নির্দিষ্ট না করে দিলেই ভালো। অনেক উন্নত দেশে তো ন্যূনতম বয়স ১২-১৩, এমন উদাহরণ দিচ্ছে অনেকেই।
আজকাল ধর্ষণ, নির্যাতন আর বঞ্চনার খবর পড়তে পড়তে মানুষ এতোই ক্ষিপ্ত হয় যে তারা যৌন সন্ত্রাসী ও নারীবিদ্বেষী বা যৌতুকলোভীদের প্রকাশ্যে পেটানোর বা খোজা করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এইসব নরকের কীটরা যদি নিজেদের সংযত করতে না পারে, যদি তাদের বিকৃত যৌন আচরণকে নিয়ন্ত্রণ না করে আবার পুলিশ-আদালত ও সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে অতীতের মতোই ব্যর্থ হয়, তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে…মানে সচেতন বিক্ষুব্ধ জনগণ আইন হাতে তুলে নিবে। তখন এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
ASK_acid_2016
এসিড সন্ত্রাসকে প্রতিশোধমূলক আচরণ হিসেবে বেশি দেখা যায়। প্রেমের সম্পর্ক বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা মেয়েদের উপর এসিড হামলা বেশি ঘটে।

মনে রাখতে হবে, এই বাংলাদেশে গত ২৬ বছরের মধ্যে ২৪ বছরই ক্ষমতায় ছিলেন দুইজন নারী প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী-এমপি-স্পীকার অনেকেই নারী। কিন্তু পুরো ্সিস্টেমটাই পুরুষদের দখলে।

নারী-প্রগতি ঠেকাও আন্দোলন কেন শুরু হলো?
শহরে-গ্রামে, দেশে-বিদেশে আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়ে এখন পড়াশুনা, চাকরি, ব্যবসা, ঘুরাঘুরি, শপিং করছে, বই পড়ছে, সিনেমা দেখছে, পছন্দের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করছে, প্রেম করছে, এডভেঞ্চার করছে…দেরী করে বিয়ে করছে, যৌতুকের বিরোধীতা করছে, পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছে, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অন্যায় আচরনের প্রতিবাদ করছে, বনিবনা না হলে ডিভোর্স দিচ্ছে…এগুলো আগেরদিনের মানুষের চোখে খারাপ-অবাধ্য মেয়েদের কাজ। আপনারও হয়তো ভালো লাগে না। কি আর করা! দেশের সব মেয়ে তো আপনার কথামতো চলবেনা।
এরকম বাস্তবতায় নারীদের দ্বারা সংঘটিত দুই-একটা খুচরা অপরাধের ঘটনা ফলাও করে প্রচার করে সমস্ত নারী জাতির চরিত্রহনন করার যে পদক্ষেপ আপনারা নিয়েছেন তা নারী নির্যাতন ও বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতাকে অস্বীকার করার একটা নোংরা চেষ্টা মাত্র।
আর নারীবাদী, উদারপন্থী পুরুষদের গালি দিয়ে; নারীবান্ধব আচরণের জন্য তাদেরকে মেয়েলি, হাফ লেডিস বা লুইচ্চা বলে অপমান করে বা তাদেরকে যৌন সন্ত্রাসীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা খুবই নিম্নমানের রুচির পরিচায়ক।
হায়! বাংলাদেশ কেন সভ্যতা থেকে এখনো কয়শো বছর পিছিয়ে আছে?
পুরুষদের কাছে একটা বিনীত অনুরোধ করিঃ উপকার করতে না পারেন, অন্তন্ত হাজার বছরের পুরনো শৃংখলাবদ্ধ সংস্কৃতি থেকে এদেশের নারীদের বের করে নিয়ে আসার যে সংগ্রাম পুরুষ ও নারীরা মিলে করছে তাতে বাধা দিয়েন না।
@লিখেছেন Probir Bidhan