Categories
Legal VAW

নারী নির্যাতন মামলার ৯৫% আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে!

পুলিশ সদর দপ্তরের ‘মামলায় সাজা ও খালাসের নথি’ থেকে গত ছয় মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।

নারী নির্যাতন মামলার ক্ষেত্রে গড়ে খালাস পায় ৯৫ শতাংশ আসামি, খবর সমকালের।

এর পেছনের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মামলার তদন্ত পর্যায়ে দুর্বলতা এবং আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে বেশি দায়ী করেছেন। সাক্ষীর অভাব এবং বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক বাদীও মামলা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। নষ্ট হয়ে যায় আলামত। এতে সুবিধা পেয়ে যায় আসামিরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের নথির তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে মোট ৪৩ হাজার ৭০৬টি মামলার রায় ঘোষণা হয়। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৯৪৬টি মামলায় এক লাখ চার হাজার ৭৭ আসামি খালাস পেয়েছে।

ধর্ষণ মামলার চলতি বছর ৮৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং শিশু নির্যাতন মামলায় ৭২ শতাংশ আসামি খালাস পেয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কেঁৗসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, অনেক সময় তদন্তের দুর্বলতা, সাক্ষীর অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। কিছু মামলায় সাক্ষীরা আদালতে উল্টাপাল্টা সাক্ষ্য দেয়। অনেক মামলায় বছরের পর বছর সাক্ষী উপস্থিত হয় না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, মূলত তিনটি কারণে আসামিরা খালাস পাচ্ছে। প্রথমত, মামলা নেওয়ার আগে সঠিকভাবে তদন্ত হয় না। তাই অনেক মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে। এসব মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তদন্ত পর্যায়ে পুলিশের অদক্ষতা, দুর্বলতা, আর্থিক লাভ ও রাজনৈতিক চাপে মামলার ক্ষতি হয়। তৃতীয়ত, দেশে সাক্ষীর জন্য কোনো ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। তাই ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীরা হাজির হতে চায় না। তবে দেওয়ানি মামলায় সাক্ষীর অভাব হয় না। কারণ, দেওয়ানি মামলায় জিতে গেলে সাক্ষীরও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক এবং ময়নাতদন্ত ও ধর্ষণের আলামত নির্ণয়কারীদের সংগঠন দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব সোহেল মাহমুদ সমকালকে বলেন, প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক সময় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটির অভিযোগ ওঠে।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হলে অনেক সময় মামলার ‘মেরিট’ নষ্ট হয়। গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলামতও নষ্ট হয়। এ ছাড়া মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষীকে নিরুৎসাহিত করে ফেলে। কেউ কেউ এখন সুবিধা নিয়ে আপসও করে ফেলেন। এমনও অভিযোগ আছে, প্রসিকিউশনের কেউ বাদী-বিবাদী দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মামলার ক্ষতি করেন।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এখন পুলিশ তদন্তে বস্তুগত আলামত সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক আলামতও রাখছে। সারাদেশে চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ও পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। থানা পুলিশও অনেক মামলার তদন্ত করে। সামগ্রিকভাবে কীভাবে তদন্তের মান বাড়ানো যায় এ নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো অপরাধ ঘটলে তা তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার নিষ্পন্ন হওয়া পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সুই-সুতার মতো। ছোট ছোট গাঁথুনি দিয়ে তা যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে হয়। মাঝপথে কোনো জায়গায় ছন্দপতন হলে ক্ষতির ছাপ পড়ে পুরো প্রক্রিয়ায়। তদন্ত করে যেমনি চার্জশিটে অপরাধ প্রমাণের মতো তথ্য-উপাত্ত থাকতে হবে, তেমনি আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব সরকারি কেঁৗসুলিদের। আবার অনেক সময় সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে চার্জশিট ও ময়নাতদন্তের মিল থাকে না। এর ফলে আসামিপক্ষ আদালতে গিয়ে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।

অনেক সময় আলোচিত ঘটনায় আসামি খালাস পেলে জনমনে প্রশ্ন ওঠে, কেন কী কারণে তারা খালাস পেল। এটা কি তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ও সরকারি কেঁৗসুলিদের ব্যর্থতা? ঢাকার মালিবাগে ১৭ বছর আগে বুশরা হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে নিম্ন আদালতের দণ্ডিত চার আসামির সবাইকে ২০১৬ সালে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ২০০৩ সালে এ মামলায় তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।

অধিকাংশ মামলায় আসামির খালাসের কারণ হিসেবে তদন্ত ও রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হয়।

By ProbirKumar Sarker

Journalist, reseacher, street photographer, entrepreneur

Leave a comment